ভাবুন তো, কয়েক টুকরো বাঁশ, কয়েকটি কাঠ আর দড়ি দিয়ে বানানো একটি নদীপথের বাহন- সেটিই এখন ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে “লোকজ স্থাপত্য” (vernacular architecture) হিসেবে পড়ানো হচ্ছে!
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়েছেন। আমাদের গ্রামবাংলার চিরচেনা পালতোলা নৌকা, পানসি বা ডিঙি এখন পশ্চিমাদের চোখে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং আর্ট’।
চলুন আজ জেনে নিই, বাংলাদেশি নৌকা ডিজাইন কীভাবে পৌঁছে গেছে ইউরোপের ক্লাসরুমে।
বাংলাদেশের নৌকা: কেবল বাহন নয়, একটি শিল্প
বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূখণ্ডে ২০০-রও বেশি প্রকারের নৌকা ব্যবহৃত হতো বিভিন্ন অঞ্চলে।যেমন: ডিঙি, পানসি, বালাম, সাম্পান, কিস্তি, বোয়ালিয়া, পালনৌকা ইত্যাদি। আঞ্চলিক বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব নৌকা প্রাকৃতিক আইন মেনেই তৈরি, তবু ডিজাইন এত নিখুঁত যে আধুনিক ইঞ্জিনিয়াররাও বিস্মিত।
ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণায় বাংলাদেশের নৌকা
ব্রিটেনের University College London (UCL), জার্মানির Technical University of Berlin, নেদারল্যান্ডসের Delft University of Technology তে নৌ প্রকৌশল ও আর্কিটেকচার বিভাগের “Vernacular Naval Architecture” কোর্সে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশি নৌকার কাঠামো, ডিজাইন ও কৌশল।
এছাড়াও গবেষণা ও থিসিস পেপারে, ডিঙি ও পানসি নৌকার জলপ্রতিরোধী কাঠামো, পাল ব্যবহারের কৌশল, কেবলমাত্র মানুষের অভিজ্ঞতায় নির্মিত ভারসাম্যপূর্ণ ডিজাইন গবেষণার মূল বিষয় হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী ও তথ্যচিত্রে বাংলাদেশের নৌকা
British Museum-এ “Boats of the World” এক্সিবিশনে পানসি ও বালাম নৌকার রেপ্লিকা প্রদর্শিত হয়েছিল।
জার্মানির Museum of River Transport এ বাংলাদেশের নৌকা নিয়ে স্থায়ী গ্যালারি স্থাপন হয়েছে।
তথ্যচিত্র:
ব্রিটিশ নৌ বিশেষজ্ঞ James Hornell এবং ভারতীয়-ব্রিটিশ নির্মাতা Clare Arni এর ডকুমেন্টারি "The Boat Builders of Bengal" এ বাংলাদেশের নৌকা তুলে ধরা হয়।
কেন এই ডিজাইন এত গুরুত্বপূর্ণ?
CAD বা কোন ধরনের ডিজাইন সফটওয়্যার ও উন্নত প্রযুক্তি ছাড়াই সম্পূর্ণ মানব অভিজ্ঞতা দিয়ে তৈরি, যাতে স্রোতের চাপ ও বাতাসের ভারসাম্য বজায় থাকে। প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব উপকরণ যেমন কাঠ, বাঁশ, নারকেলের দড়ি ইত্যাদি দিয়ে তৈরি এসব নৌকার ডিজাইন পরিবেশ ও স্থান অনুযায়ী একেক অঞ্চলে একেক রকম। যেমন পদ্মা মেঘনা নদীতে চলাচলকারী পানসী নৌকা ও চট্টগ্রাম কক্সবাজার অঞ্চলের সাম্পান নৌকার ডিজাইন এক রকম নয়। সাম্পান নৌকা এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে সাগরের উত্তাল স্রোতেও টিকে থাকে।
আমাদের জন্য কৃতিত্ব ও গর্ব
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নৌকা শুধু অতীতের বিষয় নয়, বরং এটি এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত স্থাপত্য ও নৌ প্রকৌশল ডিজাইন।
একটি সময় যা শুধুই ছিল নদীপথের একটি বাহন, আজ তা হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক শিক্ষা ও শিল্পের অংশ।
আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, লোকজ জ্ঞান এবং বাস্তবিক অভিজ্ঞতার মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই বাংলাদেশি নৌকা ডিজাইন প্রমাণ করে, শুধুমাত্র যান্ত্রিকভাবে নয়, মানুষের অভিজ্ঞতা ও প্রাকৃতিক বুদ্ধিতেও প্রযুক্তির উদ্ভাবন সম্ভব।
পশ্চিমারা যা গবেষণা করে শিখছে, আমরা সেটাই বানিয়ে চলেছি শতাব্দীর পর শতাব্দী, কোন আধুনিক ও উন্নত যন্ত্রপাতি ছাড়াই। তাই নিজস্ব ঐতিহ্যকে ছোট না দেখে, গর্ব করাই উচিত।
Post a Comment